সপ্তম অধ্যায়
রাসায়নিক বিক্রিয়া(Chemical Reaction)
LECTURE SHEET
জেনে রাখ:
• পরিবেশে বিদ্যমান পদার্থগুলো বাহ্যিক তাপ, চাপ ও অন্য পদার্থের সংস্পর্শে পরিবর্তিত হয়।
• বিশুদ্ধ পদার্থে মৌলসমূহের একটি নির্দিষ্ট শতকরা সংযুক্তি থাকে।বরফ,পানি ও জলীয় বাষ্পের প্রতিটি উপাদানে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের শতকরা সংযুক্তি অভিন্ন।এখানে শুধু ভৌত পরিবর্তন ঘটে বলে এমন হয়।
•মোম জ্বালানোর সময় ভৌত পরিবর্তন ও রাসায়নিক পরিবর্তন উভয়ই সংঘটিত হয়। এখানে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে বলে শতকরা সংযুক্তির পরিবর্তন হয়।
•রাসায়নিক পরিবর্তনে পদার্থের পরমাণু সমূহের মধ্যবর্তী বন্ধন ভেঙে নতুন বন্ধন গঠিত হয়।
রাসায়নিক বিক্রিয়া:
• রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম ভিন্ন হয়।
• রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণু সমূহের মধ্যবর্তী বন্ধন ভাঙে এবং নতুন বন্ধন গঠনের মাধ্যমে রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
• বন্ধন ভাঙা এবং নতুন বন্ধন গঠনে শক্তির পরিবর্তন হয়, যা তাপ হিসেবে অনুভূত হয়। বন্ধন ভাঙা-গড়ার সময় কোনো বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় এবং কোনো বিক্রিয়ায় তাপ শোষিত হয়।
•রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বিক্রিয়ার দিক, বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তন এবং ইলেকট্রন স্থানান্তরের ওপর
ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগ করা হয়।
• বিক্রিয়ার দিকের ওপর ভিত্তি করে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে একমুখী ও উভমুখী এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
একমুখী বিক্রিয়া: শুধু বিক্রিয়ক পদার্থ উৎপাদ পদার্থে পরিণত হয়।একমুখী বিক্রিয়ায় একমুখী তীর চিহ্ন (→) ব্যবহার হয়।
উভমুখী বিক্রিয়া: বিক্রিয়ক পদার্থ সমূহ বিক্রিয়া করে উৎপাদে পরিণত হয়, একই সাথে উৎপন্ন পদার্থ সমূহ বিক্রিয়া করে বিক্রিয়কে পরিণত হয়। আর উভমুখী বিক্রিয়ায় উভমুখী তীর চিহ্ন(⇔) ব্যবহার হয়।
•তাপের পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে তাপ উৎপাদী ও তাপহারী এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া:
বিক্রিয়ক থেকে উৎপাদ উৎপন্ন হওয়ার সময় তাপশক্তি উৎপন্ন হলে তাকে তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া বলে। তাপ উৎপাদী বিক্রিয়ার ∆H এর মান ঋণাত্মক(-) হয়।
তাপহারী বিক্রিয়া: বিক্রিয়ক থেকে উৎপাদ উৎপন্ন হওয়ার সময় তাপশক্তি শোষিত হলে তাকে তাপহারী বিক্রিয়া বলে। তাপহারী বিক্রিয়ায় ∆H এর মান ধনাত্মক(+) হয়।
•ইলেকট্রন স্থানান্তরের ওপর ভিত্তি করে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে রেডক্স ও ননরেডক্স এই দুই ভাগে
ভাগ করা হয়।
রেডক্স বিক্রিয়া:
•ইলেকট্রন স্থানান্তরের মাধ্যমে সংঘটিত সকল বিক্রিয়াই জারন-বিজারণ বিক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এর অন্তর্ভুক্ত বিক্রিয়াসমূহ হলো- সংযোজন, বিযোজন, প্রতিস্থাপন ও দহন বিক্রিয়া।
ননরেডক্স বিক্রিয়া:
•ইলেকট্রন স্থানান্তরবিহীন বা ননরেডক্স বিক্রিয়াসমূহ হলো প্রশমন বিক্রিয়া ও অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া। জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিক্রিয়কের একাধিক মৌলের মধ্যে ইলেকট্রন আদান-প্রদান ঘটে।
জারণ সংখ্যা:যৌগ গঠনের সময় কোনো মৌল যত সংখ্যক ইলেকট্রন বর্জন করে ধনাত্মক আয়ন উৎপন্ন করে অথবা যত সংখ্যক ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়ন উৎপন্ন করে তাকে মৌলের জারণ সংখ্যা বলে।
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া:
•জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার সময় বিক্রিয়ক থেকে ইলেকট্রন বর্জন বা অপসারণ প্রক্রিয়াকে জারণ বলে। আর বিক্রিয়ক কর্তৃক ইলেকট্রন গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বিজারণ বলে।
•বিক্রিয়ার প্রকারভেদ:
১.সংযোজন বিক্রিয়ায় দুই বা ততোধিক যৌগ বা মৌল যুক্ত হয়,
২.বিযোজন বিক্রিয়ায় কোনো যৌগ ভেঙে একাধিক যৌগ বা মৌলে পরিণত হয় ।
৩.প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় কোনো যৌগের একটি মৌল বা যৌগমূলক অপর কোনো মৌল বা যৌগমূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে নতুন যৌগ উৎপন্ন করে।
৪.দহন বিক্রিয়ায় কোনো মৌল বা যৌগকে বায়ুর অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে মৌলের অক্সাইড উৎপন্ন করা হয়।
৫. যে বিক্রিয়ায় এসিড ক্ষার বিক্রিয়া করে লবন ও পানি তৈরি করে তাকে প্রশমন বিক্রিয়া বলা হয়।
৬.যে বিক্রিয়ার পাত্রের তলদেশে কঠিন পদার্থ জমা হলে, তাকে অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া বলে।
৭.আরও কয়েকটি বিশেষ বিক্রিয়া আছে। এগুলো হলো- আর্দ্র বিশ্লেষণ বা পানি বিশ্লেষণ বিক্রিয়া,
পানি যোজন বিক্রিয়া, সমাণুকরণ বিক্রিয়া, পলিমারকরণ বিক্রিয়া ইত্যাদি।
দৈনন্দিন কাজে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ব্যবহার:
•দৈনন্দিন কাজে আমরা যেসব দ্রব্য ব্যবহার করি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান তাদের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে। যেমন:
•আয়রনের (লোহা) তৈরি দ্রব্যকে বায়ুতে মুক্ত অবস্থায় রেখে দিলে আয়রন বায়ুর জলীয়বাষ্পের সাথে বিক্রিয়া করে আয়রনের অক্সাইড (মরিচা) উৎপন্ন করে।
মরিচার রাসায়নিক সংকেত- Fe₂O₃.nH₂O
•আয়রনের ন্যায় অ্যালুমিনিয়াম ধাতু বায়ুর অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড উৎপন্ন করে।
•মৌমাছির কামড়ে অম্লীয় উপাদান থাকে যা নিবারণ করার জন্য ক্ষারীয় পদার্থ চুন ব্যবহার করা হলে প্রশমন বিক্রিয়া ঘটে এবং উপশম হয়।
•শর্করা জাতীয় খাদ্য বায়ু থেকে গ্রহণ করা শরীরের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে CO₂, পানি ও শক্তি উৎপন্ন করে।মানুষের শরীরে সংঘটিত এই প্রক্রিয়াকে শ্বসন বলে।
• মানবদেহের পাকস্থলিতে অতিরিক্ত HCI গ্যাস উৎপন্ন হলে এন্টাসিড জাতীয় ঔষধ সেবনে উপকার পাওয়া যায়। ক্ষারধর্মী এন্টাসিড এসিডধর্মী HCI কে প্রশমন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রশমিত করে।
• জ্বালানির দহনে CO₂, H₂O ও তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। জ্বালানির আংশিক দহনে CO₂ এর পরিবর্তে CO বা C উৎপন্ন হয় যা কালো ধোঁয়া সৃষ্টি করে এবং কম তাপ উৎপন্ন হয়।
জেনে রাখ:
•প্রয়োজনীয় উৎপাদ ও শক্তি উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন হলেও কোনো কোনো
উৎপাদের কারণে স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়। এক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়।
• বায়ু ও পানির সংস্পর্শে আয়রন বিক্রিয়া করে মরিচা উৎপন্ন করে। আয়রনের উপর রং বা ধাতুর প্রলেপ দিলে একে বায়ু ও পানির সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা যায়।
• একটি ধাতুর উপর জিংক ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে গ্যালভানাইজিং, টিনের প্রলেপ দেওয়াকে টিন
প্লেটিং এবং তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে অন্য ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে তড়িৎ প্রলেপন বলে। সংকর ধাতু ব্যবহার করে ধাতুর ক্ষয়রোধ করা যায়।
বিক্রিয়ার হার:
• প্রতি একক সময়ে (প্রতি সেকেন্ডে / প্রতি মিনিটে/ প্রতি ঘণ্টায় ) কোনো একটি বিক্রিয়াপাত্রে যে পরিমাণ উৎপাদের ঘনমাত্রা বৃদ্ধি পায় অথবা বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা হ্রাস পায় তাকে বিক্রিয়ার হার বা গতিবেগ বলে।
• বিক্রিয়ক এবং উৎপাদের ঘনমাত্রাকে মোললিটার এককে প্রকাশ করা হয়।
• অতএব, বিক্রিয়ার হারের একক হবে- মোল লিটার সময় ⁻¹ ।
•বিক্রিয়ার তাপমাত্রা, বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা ও বিক্রিয়কের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধির সাথে বিক্রিয়ার হার বৃদ্ধি পায়।
•প্রভাবক ব্যবহারে বিক্রিয়ার হার বৃদ্ধি এবং হ্রাস উভয়ই হতে পারে।
লা-শাতেলিয়ারের নীতি:
•উভমুখী বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ার যে কোনো একটি নিয়ামক (তাপমাত্রা /চাপ/বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা) পরিবর্তন (হ্রাস/বৃদ্ধি) করলে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন হয় যেন নিয়ামক পরিবর্তনের ফলাফল প্রশমিত হয়। এটি লা-শাতেলিয়ারের নীতি নামে পরিচিত।
১.তাপের প্রভাব:
• তাপ উৎপাদী বিক্রিয়ায় ক্ষেত্রে: তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা ডানদিক থেকে বাম দিকে অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ হ্রাস করে আর বিক্রিয়কের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আর তাপমাত্রা হ্রাস করলে সাম্যাবস্থা ডান দিকে অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
• তাপহারী বিক্রিয়ায় ক্ষেত্রে: তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা বাম দিক থেকে ডানদিকে অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আর তাপমাত্রা হ্রাস করলে সাম্যাবস্থা ডান দিক থেকে বামদিকে অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ হ্রাস করে।
২. চাপের প্রভাব:
• আয়তন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে: আয়তন বৃদ্ধি / মোল সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে যদি চাপ বৃদ্ধি করা হয় তবে সাম্যবস্থা ডানদিক থেকে বামদিকে অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ হ্রাস করে আর চাপ হ্রাস করলে সাম্যবস্থা বামদিক থেকে ডানদিক অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
• আয়তন হ্রাসের ক্ষেত্রে:
আয়তন হ্রাস / মোল সংখ্যা হ্রাস পেলে যদি চাপ বৃদ্ধি করা হয় তবে সাম্যবস্থা বামদিক থেকে ডানদিক অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আর চাপ হ্রাস করলে সাম্যবস্থা ডানদিক থেকে বামদিকে অগ্রসর হয়ে উৎপাদের পরিমাণ হ্রাস করে।
৩.ঘনমাত্রার প্রভাব:
বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় যে কোনো একটি বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা বৃদ্ধি করলে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা ডান
দিকে অগ্রসর হয়। আর উৎপাদের ঘনমাত্রা বৃদ্ধি করলে সাম্যাবস্থা বাম দিকে অগ্রসর হয়।
প্রশমন বিক্রিয়া:
•এসিড ও ক্ষারকের মধ্যে প্রশমন বিক্রিয়া ঘটে।
•প্রশমন বিক্রিয়ায় নিরপেক্ষ যৌগ হিসেবে লবণ ও পানি উৎপন্ন হয়।
যেমন: HCI এর দ্রবণে ফোটায় ফোটায় Na₂CO₃ দ্রবণ যোগ করলে NaCl, CO₂ ও H₂O উৎপন্ন
হয়।
Na₂CO₃ + HCI → NaCl + CO₂ + H₂O
(ক্ষারক) (এসিড) (লবন)
• ক্ষারীয় দ্রবণে লাল লিটমাস পেপারের বর্ণ নীল হয় এবং অম্লীয় দ্রবণে নীল লিটমাস পেপারের বর্ণ লাল হয়।
•লিটমাস পেপার ব্যবহার করে দ্রবণের pH নির্ণয় করা হয়।
অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া:
• যে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন যৌগ অধঃক্ষেপ হিসেবে পাত্রের তলদেশে জমা হয় তাকে অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া বলে।
• অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বিক্রিয়ক দুটি সাধারণত আয়নিক যৌগ হয়।
•বিক্রিয়কের যেসব আয়ন জলীয় দ্রবণে অংশগ্রহণ করে না তাদের দর্শক আয়ন বলে। ফেরাস সালফেট দ্রবণের সাথে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড দ্রবণ বিক্রিয়া করে পানিতে অদ্রবণীয় ফেরাস হাইড্রক্সাইড ও দ্রবণীয় সোডিয়াম সালফেট উৎপন্ন করে।
পদার্থের পরিবর্তন : যে পরিবর্তন থেকে পদার্থের বাহ্যিক অবস্থা এবং মূল গঠন বা অণুর গঠনের সাধারণ পরিচয় পাওয়া যায় তাকে পদার্থের পরিবর্তন বলে।
ভৌত পরিবর্তন:যে পরিবর্তনে পদার্থের মূল গঠনের কোনো পরিবর্তন ঘটে না অর্থাৎ কোনো নতুন পদার্থ উৎপন্ন হয় না, শুধু পদার্থের বাহ্যিক বা ভৌত অবস্থার রুপান্তর ঘটে, সেই পরিবর্তনকে ভৌত পরিবর্তন বলে।
•ভৌত পরিবর্তন অস্থায়ী। এই পরিবর্তনে পদার্থের অণুর গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না। বরফের গলন, পানির স্ফুটন, লোহার চুম্বকের পরিবর্তন, মোমের গলন ইত্যাদি ভৌত পরিবর্তনের উদাহরণ।
রাসায়নিক পরিবর্তন : যে পরিবর্তনে পদার্থের মূল গঠনের পরিবর্তন ঘটে এবং পদার্থটি এক বা একাধিক ভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট নতুন পদার্থে পরিণত হয়, সেই পরিবর্তনকে রাসায়নিক পরিবর্তন বলে। •রাসায়নিক পরিবর্তন স্থায়ী। এই পরিবর্তনে পদার্থের অণুর গঠনে আমূল পরিবর্তন ঘটে।
লোহায় মরিচা পড়া, মোমবাতির দহন, দুধ থেকে দই প্রস্তুত, চাল থেকে ভাত তৈরি ইত্যাদি রাসায়নিক পরিবর্তনের উদাহরণ।
একমুখী বিক্রিয়া :
•যে বিক্রিয়ায় সকল বিক্রিয়ক পদার্থ একটি নির্দিষ্ট সময় পরে উৎপাদে পরিণত হয় তাকে একমুখী বিক্রিয়া বলে।
•একমুখী বিক্রিয়া শুধু সম্মুখদিকে অগ্রসর হয়। এ বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের মধ্যে একমুখী (→) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
•যেমন: পটাসিয়াম ক্লোরেটকে উত্তপ্ত করলে এটি বিয়োজিত হয়ে পটাসিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন উৎপন্ন হয়। বিপরীতভাবে, পটাসিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেনের মধ্যে কোনো বিক্রিয়া ঘটে না। সুতরাং, এটি একটি একমুখী বিক্রিয়া।
∆
2KCIO₃ → 2KCI + 30₂
উভমুখী বিক্রিয়া :
• যদি কোনো বিক্রিয়া একসাথে সম্মুখদিক ও বিপরীত দিক থেকে সংঘটিত হয়, ওই বিক্রিয়াকে উভমুখী বিক্রিয়া বলে।
• উভমুখী বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহ কখনোই সম্পূর্ণরুপে উৎপাদে পরিণত হয় না।
• নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও চাপে বিক্রিয়কের একটি অংশমাত্র উৎপাদে পরিণত হয়।
• উভমুখী বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক এবং উৎপাদের মধ্যে উভমুখী তীর চিহ্ন (==) ব্যবহার করা হয়।যেমন : হাইড্রোজেন ও আয়োডিনকে একটি আবদ্ধ পাত্রে নিয়ে উত্তপ্ত করা হলে কিছুটা বিক্রিয়ক হাইড্রোজেন আয়োডাইড উৎপন্ন করে। বিক্রিয়াটি নিম্নরুপে ঘটে-
H₂+I₂ == 2HI
তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া:
• যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় তাকে তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া বলে।
•যেমন: হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেনের বিক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়। এতে তাপ উৎপন্ন হয় ।প্রভাবক হিসেবে আয়রন(Fe) ব্যবহৄত হয় ।
N₂+ 3H₂ == 2NH₃ + 92kJ
তাপহারী বিক্রিয়া: যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপ শোষিত বা গৃহীত হয় তাকে তাপহারী বা তাপগ্রাহী বা তাপ শোষক বিক্রিয়া বলে।
যেমন : নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেনের সংযোগে নাইট্রিক অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং তাপ শোষিত হয়।
N₂ + O₂ == 2NO - 180 kJ
রেডক্স বিক্রিয়া:
• রেডক্স অর্থ জারণ-বিজারণ।
• যে বিক্রিয়া ইলেকট্রন স্থানান্তরের মাধ্যমে সংঘটিত
হয় তাকে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া বা রেডক্স বিক্রিয়া বলে।
• এতে বিক্রিয়কের জারণ সংখ্যার পরিবর্তন হয়।
জারণ সংখ্যা :
•যৌগ গঠনের সময় কোনো মৌল যত সংখ্যক ইলেকট্রন বর্জন করে ধনাত্মক আয়ন উৎপন্ন করে অথবা যত সংখ্যক ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়ন উৎপন্ন করে তাকে মৌলের জারণ সংখ্যা বলে।
• নিরপেক্ষ বা মুক্ত মৌলের জারণ সংখ্যা শূন্য (০) ধরা হয়।
• ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হলে মৌলের জারণ সংখ্যাকে ঋণাত্মক জারণ সংখ্যা
• ইলেকট্রন বর্জন করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হলে মৌলের জারণ সংখ্যাকে ধনাত্মক জারণ সংখ্যা বলে।
জারক ও বিজারক :
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার সময় যে বিক্রিয়ক ইলেকট্রন গ্রহণ করে তাকে জারক এবং যে বিক্রিয়ক ইলেকট্রন বর্জন করে তাকে বিজারক বলে।
১.জারক পদার্থ: O₂, H₂O₂, O₃, HNO₃, গাঢ় H₂SO₄, হ্যালোজেন (F₂, Cl₂ . Br₂. I₂ ), MnO₂, KMnO₄, K₂Cr₂O₇, KCIO₃, প্রভৃতি জারক পদার্থ।
২.বিজারক পদার্থ: H₂, H₂S, C, CO. SO₂, Na .Mg . SnCl₂, HI, HBr, NH₃, HNO₂ প্রভৃতি বিজারক পদার্থ।
জারণ ও বিজারণ:
• জারণ ও বিজারণ একই সঙ্গে ঘটে ।
• রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জারণ ও বিজারণ ক্রিয়া একই সঙ্গে ঘটে।
• কারণ: জারণ বিক্রিয়ায় জারক পদার্থ বিজারিত হয়। আবার, বিজারণ ক্রিয়ায় বিজারক পদার্থ নিজে জারিত হয়। সুতরাং, জারণ ক্রিয়া ঘটলেই বিজারণ ক্রিয়াও ঘটবে। জারণ ও বিজারণ বিক্রিয়াকে একই সঙ্গে রেডক্স (Redox) বিক্রিয়া বলা হয়।
সংযোজন বিক্রিয়া: দুই বা ততোধিক যৌগ বা মৌল যুক্ত হয়ে নতুন যৌগ উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়ার নাম সংযোজন বিক্রিয়া।যেমন :
2FeCl₂ (aq) + Cl(g) → 2FeCl₃ (aq)
H₂ (g) + Cl₂ (g) → 2HCl (g)
বিয়োজন বিক্রিয়া : কোনো যৌগকে ভেঙে একাধিক যৌগ বা মৌলে পরিণত করার প্রক্রিয়ার নাম বিযোজন বিক্রিয়া। যেমন :
ᵢ) PCl₅ (l) → PCI₃ (I) + Cl2 (g)
ᵢᵢ) 2H₂O (l) → 2H₂ (g) + O₂ (g)
প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া: কোনো যৌগের একটি মৌল বা যৌগমূলককে অপর কোনো মৌল বা যৌগমূলক
দ্বারা প্রতিস্থাপন করে নতুন যৌগ উৎপন্ন করার প্রক্রিয়ার নাম প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া। যেমন:
Zn (s) + H₂SO₄ (aq) → ZnSO₄ (aq) + H₂ (g)
2Na (s) + CuSO₄ (aq) → Na₂SO₄ (aq) + Cu(s)
দহন বিক্রিয়া: কোনো মৌলকে বা যৌগকে বায়ুর অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে তার উপাদান মৌলের অক্সাইডে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে দহন বিক্রিয়া বলে। যেমন:
CH₄ (g) + 2 O₂ (g) → CO₂ (g) + 2H₂O(g)
C (s) + O₂ (g) → CO₂ (g)
2H₂ (g) + O₂ (g) → 2H₂O (g)
নন-রেডক্স বিক্রিয়া:
• এক বা একাধিক বিক্রিয়ক থেকে নতুন যৌগ উৎপন্ন হওয়ার সময় বিক্রিয়কে বিদ্যমান মৌলসমূহের মধ্যে ইলেকট্রন আদান-প্রদান না হলে সে বিক্রিয়াকে নন-রেডক্স বিক্রিয়া বলে।
•প্রশমন বিক্রিয়া ও অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া নন-রেডক্স বিক্রিয়া।
প্রশমন বিক্রিয়া:
• জলীয় দ্রবণে এসিড ও ক্ষার বিক্রিয়া করে লবণ ও পানি উৎপন্ন করার বিক্রিয়াকে প্রশমন বিক্রিয়া বলে। প্রশমন বিক্রিয়া সম্পন্ন হলে pH এর মান 7 হয়।যেমন :
HCl (aq) + NaOH (aq) → NaCl (aq) + H₂ (l)
অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া:
• যে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন যৌগ অধঃক্ষেপন হিসেবে পাত্রের তলদেশে জমা হয় তাকে
অধঃক্ষেপন বিক্রিয়া বলে।
• অধঃক্ষেপন প্রকাশ করার জন্য উৎপাদের সামনে ↓ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন:
NaCl (aq) + AgNO₃ (aq) → NaNO₃ (aq) + Ag (↓)
আর্দ্রবিশ্লেষণ / পানি বিশ্লেষণ বিক্রিয়া:
• পানির অণুতে ধনাত্মক হাইড্রোজেন আয়ন (H') ও
ঋণাত্মক হাইড্রোক্সিল আয়ন (OH) থাকে।
• কোনো যৌগের দুই অংশ পানির বিপরীত আধানবিশিষ্ট দুই অংশের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন যৌগ উৎপন্ন করে। এই বিক্রিয়াকে আর্দ্রবিশেষণ বিক্রিয়া বলে।যেমন :
AICI₃ (s) + 3H₂O (l) → Al(OH)₃ (s) +3HCl (aq)
SiCl₄ + 4H₂O → Si(OH)₄ + 4HCl
পানিযোজন বিক্রিয়া: আয়নিক যৌগ কেলাস গঠনের সময় এক বা একাধিক সংখ্যক পানির অণুর সাথে যুক্ত হয়। এই বিক্রিয়াকে পানিযোজন বিক্রিয়া বলে। যেমন :
CaCl₂ + 6H₂O→ CaCl₂.6H₂O
MgCl₂ + 7H₂O → MgCl₂.7H₂O
CuSO₄ + 5H₂O → CuSO₄.5H₂O
সমাণুকরণ বিক্রিয়া: একই আণবিক সংকেতবিশিষ্ট দুটি যৌগের ধর্ম ভিন্ন হলে তাদেরকে পরস্পরের সমাণু বলে। যেমন : C₂H₆O আণবিক সংকেত বিশিষ্ট দুটি যৌগ CH₃CH₂OH ( ইথানল) ও
CH₃OCH₃ (ডাই মিথাইল ইথার)
পলিমারকরণ বিক্রিয়া: যে বিক্রিয়ায় অসংখ্য মনোমার থেকে পলিমার উৎপন্ন হয় তাকে পলিমারকরণ বিক্রিয়া বলে। যেমন: উচ্চতাপ ও চাপের প্রভাবে ভিনাইল ক্লোরাইড (CH₂ = CHCl) এর অসংখ্য অণু পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে বৃহৎ আণবিক ভরবিশিষ্ট নতুন যৌগ পলিভিনাইল ক্লোরাইড (PVC) গঠন করে।
উচ্চ তাপ ও চাপ
nH₂C = CHCl(g) →→→→ [-CH₂-CHCI-]ₙ (s)
ইলেকট্রোপ্লেটিং:
• তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় লোহা, তামা, পিতল প্রভৃতি ধাতু বা ধাতু সংকরের তৈরি দ্রব্যের ওপর নিকেল, জিংক, সিলভার, গোল্ড, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি ধাতুর প্রলেপ দেয়াকে ইলেকট্রোপ্লেটিং বলা হয়।
•কোনো কোনো ধাতুর তৈরি জিনিসপত্রকে জলবায়ু এবং বায়ুর অক্সিজেনের প্রকোপ থেকে রক্ষা করা এবং দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলাই ইলেকট্রোপ্লেটিং এর উদ্দেশ্য।
বিক্রিয়ার গতিবেগ বা বিক্রিয়ার হার: একক সময়ে একটি বিক্রিয়ার বিক্রিয়কসমূহের ঘনমাত্রা কতটুকু হ্রাস পায় বা উৎপন্ন পদার্থের ঘনমাত্রা কতটুকু বৃদ্ধি পায় তাকে বিক্রিয়ার হার বা গতি বলে।
বিক্রিয়ার গতিবেগ বা বিক্রিয়ার হার উপর তাপমাত্রা, ঘনমাত্রা ও প্রভাবকের প্রভাব:
রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবেগ কয়েকটি নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল। তন্মধ্যে তাপমাত্রা, বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা ও প্রভাবকের উপস্থিতি বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ। ঘনমাত্রা বাড়ালে বিক্রিয়ার গতিবেগ বাড়ে। প্রভাবকের উপস্থিতিতে বিক্রিয়ার গতিবেগ বাড়ে বা কমে।
রাসায়নিক সাম্যাবস্থা: যে অবস্থায় কোনো উভমুখী বিক্রিয়ার সম্মুখ বিক্রিয়ার গতিবেগ বিপরীতমুখী বিক্রিয়ার গতিবেগের সমান হয় সে অবস্থাকে রাসায়নিক সাম্যাবস্থা বলে।
• রাসায়নিক সাম্যাবস্থায় তাপমাত্রা, চাপ এবং অংশগ্রহণকারী পদার্থের দৃশ্যমান ধর্মগুলো স্থির থাকে। বিক্রিয়ার উভমূখীতার ফলেই সাম্যাবস্থার উদ্ভব ঘটে।
• একটি উভমুখী বিক্রিয়ার শুরুতে সম্মুখ বিক্রিয়ার বেগ সবচেয়ে বেশি থাকবে এবং বিপরীত বিক্রিয়ার বেগ কম থাকবে।
•সময়ের সঙ্গে বিক্রিয়কের পরিমাণ কমতে থাকবে ও উৎপাদের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
এই অধ্যায়ের সকল নোট এর পিডিএফ পেতে এখানে ক্লিক করুন---
Download Now