চতুর্থ অধ্যায়
পর্যায় সারণি (Periodic Table)
LECTURE SHEET
দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিফ (১৮৩৪ - ১৯০৭ ) ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম পর্যায়সূত্র উপস্থাপন করেন এবং মৌলসমূহকে ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের ভিত্তিতে সজ্জিত করে পর্যায় সারণি প্রণয়ন করেন।
জেনে রাখ:
১.ল্যাভয়সিয়ে সর্বপ্রথম 1789 সালে ভৌত অবস্থার উপর ভিত্তি করে মৌলসমূহকে তিন শ্রেণিতে
বিভক্ত করেন।
২.1864 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড মৌলসমূহকে তাদের ভর অনুযায়ী সাজিয়ে প্রতি অষ্টম মৌলসমূহে ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মে মিল দেখতে পান । 1869 সালে রবশ বিজ্ঞানী ম্যান্ডেলিফ এবং জার্মান বিজ্ঞানী লুথার মেয়র পারমাণবিক ভরের উপর ভিত্তি করে মৌলসমূহের একটি তালিকা প্রকাশ করেন যা রসায়নে পর্যায় সারণি নামে পরিচিত।
৩.2012 সাল পর্যন্ত 118টি মৌল শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে IUPAC 114 টিকে স্বীকৃতি
দিয়েছে।
৪.114 টি মৌলের মধ্যে 112 টির নামকরণ করা হয়েছে, 98 টি মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায়,
বাকিগুলো পরীক্ষাগারে তৈরি করা সম্ভব।
৫. প্রকৃতিতে প্রাপ্ত 98 টি মৌলের মধ্যে 84 টি মৌলকে প্রাথমিক মৌল বলা হয় এবং বাকি 14 টি মৌল তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।
৬.ল্যাভয়সিয়ে 33 টি মৌলের ছক তৈরি করেছিলেন আর ম্যান্ডেলিফ 67 টি মৌল নিয়ে পর্যায় সারণি
প্রবর্তন করেন। পর্যায় সারণির মৌলসমূহের বেশির ভাগই অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত ।
৭.পর্যায় সারণি হলো মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সন্নিবেশনের একটি ছক।
পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য:
১. পর্যায় সারণিতে ৭টি পর্যায় বা আনুভূমিক সারি ও 18 টি গ্রপ বা খাড়া স্তম্ভ রয়েছে।
২. পর্যায় - 1 এ 2 টি মৌল, পর্যায় -2 ও পর্যায় -3 এ 8 টি করে মৌল, পর্যায় -4 ও পর্যায় - 5 এ 18 টি করে মৌল, পর্যায়-6 ও পর্যায় - 7 এ 32 টি করে মৌল সন্নিবেশিত হয়েছে।
৩.পর্যায় 4 থেকে পর্যায় 7 পর্যন্ত সবগুলো পর্যায়ের প্রতিটি গ্রুপই মৌল দ্বারা পূর্ণ।
৪.পর্যায় -6 ও পর্যায় -7 এর গ্রুপ -3 তে 15 টি মৌলের অবস্থান। বাকি 17 টি গ্ৰুপে একটি করে
মৌল অবস্থান করে।
৫. একই পর্যায়ের বামদিক থেকে ডানদিকে মৌলসমূহের ধর্ম পরিবর্তিত হয়। একই গ্রুপের সকল মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম প্রায় একই রকম।
মৌলের বৈশিষ্ট্য:
১.প্রথমদিকে আবিষ্কৃত মৌলসমূহকে বিজ্ঞানীরা ধাতু ও অধাতু এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেন।
১ ধাতুসমূহের মধ্যে সোনা ও রুপা কম সক্রিয় ধাতু যাদেরকে অভিজাত ধাতু বলে। আর লোহা ও
দস্তা অধিক সক্রিয় ধাতু, যাদেরকে নিকৃষ্ট ধাতু বলে।
২.1829 সালে জার্মান বিজ্ঞানী জে. ডবিরউ, ডোবেরাইনার পারমাণবিক ভরের সাথে মৌলসমূহকে সম্পর্কিত করে ত্রয়ী সূত্র প্রদান করেন।
৩.ত্রয়ী সূত্র: পর্যায় সারণির দুটি মৌলের পারমাণবিক ভরের গড় অন্য একটি মৌলের পারমাণবিক ভরের প্রায় সমান এবং মৌল তিনটির ধর্ম একইরকম। এই মৌল তিনটিকে ডোবেরাইনার ত্রয়ী বলে।
৪.অষ্টক তত্ত্ব: 1864 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড প্রস্তাব করেন যে মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক ভর অনুযায়ী সাজালে প্রতি অষ্টম মৌলসমূহের ধর্মের মিল দেখা যায় যা 'অষ্টক তত্ত্ব' নামে পরিচিত ।
৫.ম্যান্ডেলিফের পর্যায় সূত্র: “যদি মৌলসমূহকে পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজানো হয়, তবে তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়।" ম্যান্ডেলিফের সংশোধিত পর্যায় সূত্রে পারমাণবিক ভরের স্থলে পারমাণবিক সংখ্যা হয়।
আধুনিক পর্যায় সুত্র:
১.1869 সালে বিজ্ঞানী ম্যান্ডেলিফ মৌলসমূহকে এর পারমাণবিক ভর অনুযায়ী সাজিয়ে আধুনিক পর্যায়
সারণি প্রবর্তন করেছিলেন।
২.পারমাণবিক ভর অনুযায়ী মৌলসমূহকে সাজালে আর্গন ও পটাসিয়ামের অবস্থান নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি
হয়।
৩.1913 সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা দেন। ম্যান্ডেলিফ আধুনিক পর্যায় সারণিতে পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা ব্যবহার করে এর সংশোধিত রূপ প্রকাশ করেন।
৪.কোনো মৌলের প্রোটন সংখ্যাকে পারমাণবিক সংখ্যা বলে। একটি মৌলে যদি যতটি ইলেকট্রন থাকে ঠিক ততটি প্রোটন থাকে, তাহলে ইলেকট্রন সংখ্যাকে তার পারমাণবিক সংখ্যা বলে।
৫.ইলেকট্রন সংখ্যা পরিবর্তনে পরমাণুর পরিবর্তন হয় না কিন্তু প্রোটন সংখ্যা পরিবর্তনে পরমাণুর পরিবর্তন হয়।
ইলেকট্রন বিন্যাস:
পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি ইলেকট্রন বিন্যাস। কারণ: কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসই মূলত তার রাসায়নিক ধর্মাবলি নির্দেশ করে ।
ইলেকট্রন বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য:
১. পর্যায় সারণিতে কোনো মৌলের অবস্থান তার ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে জানা যায়।
২.কোনো মৌলের যতটি শক্তিস্তরে ইলেকট্রন বিন্যস্ত থাকে শক্তিস্তরের সে সংখ্যাই হলো ঐ মৌলের পর্যায় সংখ্যা।
৩. সাধারণভাবে সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে অবস্থিত ইলেকট্রন সংখ্যাই কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ে উক্ত মৌলের গ্রুপ সংখ্যা।
৪. ইলেকট্রন দ্বারা সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে পূর্ণ মৌলসমূহ গ্রুপ-18 তে স্থান পায়।
৫. পর্যায়-4 এবং পর্যায়-7 পর্যন্ত যে সকল মৌলের d উপস্তরে ইলেকট্রন প্রবেশ করে তাদের ক্ষেত্রে d উপস্তরে প্রবেশকৃত ইলেকট্রন এবং সর্বশেষ কক্ষপথের ইলেকট্রন সংখ্যার সমষ্টি তার গ্রপ নির্দেশ
করে।
৬. পর্যায়-6 এবং পর্যায়-7 এর যে সকল মৌলের সর্বশেষ ইলেকট্রন / উপস্তরে প্রবেশ করে তাদেরকে মূল পর্যায় সারণির নিচে পৃথকভাবে অবস্থান দেয়া হয়।
মৌলের পর্যায় ও গ্ৰুপ ভিত্তিক ধর্ম:
১.ধাতু-অধাতু: পর্যায় সারণির একটি পর্যায়ের বামদিকের মৌলগুলো ধাতু। যতই ডান দিকে যাওয়া যায় ততই মৌলগুলো অধাতুতে আবর্তিত হতে থাকে। আবার যে কোনো গ্রপে যতই নিচের দিকে যাওয়া যায় মৌলসমূহের ধাতু ধর্ম ততই বৃদ্ধি পায়। তবে Si মৌলটি উপধাতু যা ধাতু ও অধাতু উভয়ের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
২.গলনাংক ও স্ফুটনাংক: গ্রুপ-1 এর ১২টি ধাতুসমূহ প্রত্যেকেই নরম, নিম্ন গলনাংকবিশিষ্ট। এ গ্রুপের ধাতুসমূহের গলনাংক
পারমাণবিক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কমে।
•পর্যায় সারণির বাম দিক থেকে ডান দিকে অর্থাৎ গ্রুপ-1 থেকে গ্রুপ−17 পর্যন্ত মৌলসমূহের গলনাংক ও স্ফুটনাংক প্রথমে বৃদ্ধি পেয়ে (ধাতু পর্যন্ত)
পরবর্তীতে (অধাতু থেকে) হ্রাস পায়। গ্রুপ-17 অর্থাৎ হ্যালোজেনসমূহের গলনাংক ও স্ফুটনাংক
গ্রুপ-১ এর ১২টি ধাতুসমূহের তুলনায় অনেক কম হয়।
•একই গ্রপের মৌলসমূহের গলনাংক ও স্ফুটনাংক পারমাণবিক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কমে.
৪.আকার: পর্যায় সারণির একই পর্যায়ের বামদিক থেকে ডানদিকে পারমাণবিক আকার হ্রাস পায় এবং কোনো গ্রুপের উপর থেকে নিচের দিকে পারমাণবিক আকার বৃদ্ধি পায়।
৫.অন্যান্য: পারমাণবিক আকার ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম যেমন আয়নিকরণ শক্তি, তড়িৎ ঋণাত্মকতা, ইলেকট্রন আসক্তি ইত্যাদি একটি পর্যায়ে পারমাণবিক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায়।
জেনে রাখ:
১.ক্ষার ধাতু: পর্যায় সারণিতে গ্রুপ-1 এ অবস্থিত মৌলসমূহ যেমন Li, Na, K, Pb, Cs এবং Fr কে ক্ষার ধাতু বলা হয়।
২.মৃৎক্ষার ধাতু: পর্যায় সারণিতে গ্রুপ-2এ অবস্থিত মৌলসমূহকে যেমন Be, Mg, Ca, Sr, Ba এবং Ra কে মৃৎক্ষার ধাতু বলা হয়।
৩.অবস্থান্তর মৌল: পর্যায় সারণিতে গ্রুপ-3 থেকে গ্রুপ-11 পর্যন্ত অবস্থিত 36 টি মৌলকে অবস্থান্তর মৌল বলা হয়
৪.118 টি মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে ধারণা নিতে পর্যায় সারণি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫.পর্যায় সারণির বাম থেকে ডান দিকের মৌলসমূহের ভৌত অবস্থা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়।
যেমন:
•পর্যায়-3 এর সর্ববামের মৌল সোডিয়াম একটি কঠিন পদার্থ আর সর্বডানে ক্লোরিন ও আর্গন গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে।
•পর্যায় সারণির গ্রুপ-1 এ অবস্থিত হাইড্রোজেন ব্যতীত অন্য মৌলগুলোকে ক্ষার ধাতু বলা হয় এবং এদের ছুরি দিয়ে কাটা যায়। এদের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তর 1 টি ইলেকট্রন প্রদান করতে পারে। হাইড্রোজেন ব্যতীত বাকি সবাই পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে। পর্যায় সারণিতে তরল মৌলের সংখ্যা খুবই কম।
পর্যায় সারণি : বিভিন্ন মৌলের ক্রমপরিবর্তন দেখানোর প্রয়াসে মৌলসমূহকে যে সারণিতে সাজানো হয়, তাকে পর্যায় সারণি বলা হয়।
1789 সালে বিজ্ঞানী ল্যাভয়শিয়ে ভৌত অবস্থার উপর ভিত্তি করে, 1864 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড মৌলসমূহের ভর অনুযায়ী, 1869 সালে রবশ বিজ্ঞানী ডিমিট্রি ম্যান্ডেলিফ পারমাণবিক ভর অনুসারে ও 1913 সালে বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে পারমাণবিক সংখ্যার উপর ভিত্তি করে পর্যায় সারণি প্রস্তাব করেছেন যা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পর্যায় সারণির রূপ লাভ করেছে।
পর্যায় : পর্যায় সারণির আনুভূমিক সারিগুলোকে পর্যায় বা Period বলে। বর্তমান পর্যায় সারণিতে মোট 7টি পর্যায় আছে। প্রতিটি পর্যায়ের মৌলগুলোর ধর্ম অভিন্ন তবে ক্রমপরিবর্তনশীল হয়। যেমন একই পর্যায়ে যতই ডানদিক যাওয়া যায়, ততই মৌলসমূহের মধ্যে ধাতুধর্ম হ্রাস পায় ও পরমাণুর আকার ছোট হয়।
শ্রেণি বা গ্রুপ : পর্যায় সারণির লম্ব স্তম্ভগুলোকে বা উপর সারিগুলোকে শ্রেণি বা Group বলে।
সদৃশ ধর্মের মৌলগুলো একটি শ্রেণিতে স্থান পায়। বর্তমান পর্যায় সারণিতে মোট 18টি গ্রপ আছে। আগে পর্যায় সারণির এ 18টি গ্রপকে রোমান হরফের সংখ্যা I থেকে VIII দ্বারা প্রকাশ করা হতো। সপ্তম শ্রেণির পরের শ্রেণিকে শূন্য শ্রেণি বলা হতো। পূর্বের এ শ্রেণিকরণকে সর্বশেষ পর্যায় সারণির সংস্করণে 18টি গ্রুপে ভাগ করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে যা IUPAC কর্তৃক গৃহীত হয়েছে।
ডোবেরাইনারের ত্রয়ীসূত্র : রাসায়নিক ধর্মের সাদৃশ্য আছে এরকম তিনটি মৌলের মধ্যবর্তী মৌলটির পারমাণবিক ভর, অন্য দুটি মৌলের পারমাণবিক ভরের গড় মানের সমান হয়। যেমন Li, Na এবং K মৌল তিনটির মধ্যে রাসায়নিক ধর্মের মিল আছে। Li এবং K-এর পারমাণবিক ভর যথাক্রমে 7 এবং 39। অতএব Na-এর পারমাণবিক ভর 7-39 46 -23।
কিন্তু সূত্রটি খুব কমসংখ্যক মৌলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ায় বিশেষ পুরণত্ব লাভ করতে পারেনি। এরপর 1864 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড তার বিখ্যাত অষ্টক তত্ত্ব প্রকাশ করেন।
নিউল্যান্ডের অষ্টক তত্ত্ব : মৌলগুলোকে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজালে কোনো একটি মৌলের ধর্মের সাথে পরবর্তী অষ্টম মৌলের ধর্মের সাদৃশ্য দেখা যাবে। এটি অষ্টক তত্ত্ব নামে পরিচিত।
যেমন : Li(7) Be (9.02) B (10.8) C(12) N(14) O(16) F(19) Na(23) Mg(24) | এক্ষেত্রে Li থেকে শুরু করে অষ্টম মৌল Na-এর ধর্মের এবং Be থেকে শুর করে অষ্টম মৌল Mg-এর ধর্মের সাদৃশ্য রয়েছে। এভাবে প্রথম দিকের কতগুলো মৌলের ক্ষেত্রে এ সূত্র প্রযোজ্য হলেও Ca(20) - পরবর্তী মৌলগুলোর ক্ষেত্রে এ সূত্র খাটে না।
ম্যান্ডেলিফের পর্যায় সূত্র : 1869 সালে রাশিয়ান রসায়নবিদ ডিমিট্রি ম্যান্ডেলিফ আবষ্কৃিত মৌলসমূহের পারমাণবিক ভরকে ভিত্তি ধরে পর্যায় সারণিতে উচ্চক্রমানুসারে সাজিয়ে দেখেন একই ধর্মবিশিষ্ট মৌলসমূহ একই কলামে স্থান পায়। তাই তিনি এভাবে সন্নিবেশিত মৌলসমূহের ক্ষেত্রে একটি সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
সূত্রটি ছিল "যদি মৌলসমূহকে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজানো হয়, তবে তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়।
1913 সালে বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে পারমাণবিক সংখ্যা আবিষ্কারের পর ম্যান্ডেলিফ তার পর্যায় সূত্র সংশোধন করেন। ম্যান্ডেলিফের সংশোধিত পর্যায় সূত্র হলো, “মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি তাদের পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়।" এই পর্যায় সূত্রটিই আধুনিক পর্যায় সারণির ভিত্তি। এ কারণে ম্যান্ডেলিফকে পর্যায় সারণির জনক বলা হয়।
পর্যায় সারণির ভিত্তি : পর্যায় সারণি সৃষ্টির সময় মৌলসমূহের পারমাণবিক ভরকে ভিত্তি ধরা
হয়েছিল। পরবর্তীতে পারমাণবিক সংখ্যাকে ভিত্তি ধরা হয়। বর্তমানে একথা স্বীকৃত যে পর্যায় সারণির সত্যিকার ভিত্তি হচ্ছে মৌলসমূহের ইলেকট্রন বিন্যাস।
*প্রতিনিধিত্বমূলক মৌলসমূহের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ স্তরে যতটি ইলেকট্রন বিদ্যমান, তা থেকে পর্যায় সারণিতে মৌলটির অবস্থান কত নম্বর গ্রপে তা হিসাব করা যায়। আর ইলেকট্রন বিন্যাসে যতটি স্তর আছে মৌলটির অবস্থান তত নম্বর পর্যায়ে।
*পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে পর্যায় সারণিতে কয়েকটি মৌলের অবস্থান নির্ণয় : সাধারণভাবে কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ শক্তিস্তরে যে কয়টি ইলেকট্রন থাকে, মৌলটির অবস্থান তত নম্বর গ্রুপে হয়। তবে দুইটি ও তিনটি শক্তিস্তরে বিন্যস্ত যে সকল মৌলের সর্বশেষ কক্ষপথে দুটির বেশি ইলেকট্রন থাকে তাদের ক্ষেত্রে সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে উপস্থিত ইলেকট্রন সংখ্যার সাথে দশ (10) যোগ করে গ্রুপ সংখ্যা নির্ণয় করা হয়। আবার, সবশেষ কক্ষপথে 8 টি ইলেকট্রন থাকলে সেই মৌল গ্ৰুপ-18 তে স্থান পায়।
নিচে একটি ছকের মাধ্যমে কিছু উদাহরণ দেখানো হলো :
পর্যায় ও গ্ৰুপ ভিত্তিক ধর্ম:
ভৌত ধর্মের সাদৃশ্য পর্যায় সারণিতে বিভিন্ন মৌলের ঘনত্ব, গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক, তাপ ও তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা ইত্যাদি ভৌত ধর্মগুলোর পর্যায়বৃত্তি দেখা যায়। পর্যায় সারণির একই পর্যায়ে কঠিন মৌলগুলোর ঘনত্ব পারমাণবিক ভর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তারপর আবার কমতে থাকে।
একই পর্যায়ে বামদিক থেকে ডানদিকে গেলে ধাতব ধর্ম কমতে থাকে, ফলে তড়িৎ পরিবাহিতা ক্রমশ হ্রাস পায়। অপরদিকে একই গ্ৰুপে যত উপর থেকে নিচে যাওয়া যায়, মৌলসমূহের ধাতু ধর্ম তত বৃদ্ধি পায়।
যেমন: রাসায়নিক ধর্মে সাদৃশ্য : পর্যায় সারণির একই শ্রেণির মৌলগুলোর রাসায়নিক ধর্ম একরকম হয়। 1 গ্রুপের Li Na K Rb এবং Cs এর রাসায়নিক ধর্মে অনেক মিল দেখা যায়। আবার, 17 গ্রুপের F Cl Br এবং I এর মধ্যে রাসায়নিক ধর্মে খুবই সাদৃশ্য আছে। সাধারণভাবে দেখা যায় একই শ্রেণির উপর থেকে যত নিচের দিকে যাওয়া যায়, মৌলগুলোর রাসায়নিক ধর্ম নিয়মিতভাবে তত বাড়ে বা কমে।
ক্ষার ধাতু : পর্যায় সারণিতে গ্রুপ-1 এ অবস্থিত মৌলসমূহ যেমন : Li Na K Rb Cs এবং Fr কে ক্ষার ধাতু (alkali metal) বলা হয়। এরা প্রত্যেকেই পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস ও ক্ষার দ্রবণ তৈরি করে। এরা সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে অবস্থিত একমাত্র ইলেকট্রনটি প্রদান করে আয়নিক যৌগ (লবণ) তৈরি করে।
মৃৎক্ষার ধাতু : গ্ৰুপ -2-এ অবস্থিত Be থেকে শুরু করে Ra পর্যন্ত মৌলসমূহকে মৃৎক্ষার ধাতু বলা (alkaline earth metal) হয়। এদের ধর্ম অনেকটা ক্ষার ধাতুর মতোই। এদের অক্সাইডসমূহ পানিতে ক্ষারীয় দ্রবণ তৈরি করে। এরাও সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরের 2টি ইলেকট্রন প্রদান করে আয়নিক যৌগ (লবণ) তৈরি করে। এই মৌলসমূহ বিভিন্ন যৌগ হিসেবে মাটিতে থাকে।
অবস্থান্তর মৌল : পর্যায় সারণিতে গ্ৰুপ -3 থেকে গ্রুপ-11 পর্যন্ত গ্রুপে অবস্থিত মৌলসমূহ
অবস্থান্তর মৌল (transition metal) হিসেবে পরিচিত। অবস্থান্তর মৌলসমূহের নিজস্ব বর্ণ রয়েছে। এরা ধাতব পদার্থ হিসেবে প্রচুর ব্যবহৃত হয়। সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন প্রদান করে আয়নিক যৌগ তৈরি করে। কোনো পর্যায়ের অবস্থান্তর মৌলসমূহের মধ্যে বামদিকের মৌল থেকে ডানদিকের মৌল দ্বারা গঠিত যৌগের বৈশিষ্ট্য আয়নিক থেকে সমযোজীতে পরিবর্তিত হয়।
মুদ্রা ধাতু : পর্যায় সারণিতে গ্রুপ-11-তে অবস্থিত মৌল-তামা (Cu), রপা (Ag) ও সোনা (Au) এদের ধাতব বৈশিষ্ট্যসহ উজ্জ্বলতা বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে এসব ধাতু দ্বারা মুদ্রা তৈরি করে তাদেরকে ক্রয়-বিক্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এদেরকে মুদ্রা ধাতু (coinage metals) বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এরা অবস্থান্তর মৌল।
হ্যালোজেন মৌল: গ্রুপ-17 তে অবস্থিত মৌল F Cl Br I At এই 5টি মৌলকে একত্রে হ্যালোজেন (halogen) বলে। হ্যালোজেন শব্দের অর্থ লবণ গঠনকারী (salt maker)। এরা সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে একটি ইলেকট্রন গ্রহণের মাধ্যমে হ্যালাইড আয়ন তৈরি করে। হ্যালোজেনসমূহের মূল উৎস সামুদ্রিক লবণ। এরা নিজে নিজেই ইলেকট্রন ভাগাভাগির (electron sharing) মাধ্যমে দ্বি-মৌল অণু তৈরি করে।
নিষ্ক্রিয় গ্যাস : পর্যায় সারণিতে গ্রুপ-18-তে অবস্থিত মৌলসমূহকে নিষ্ক্রিয় মৌল বলে। কারণ এদের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ থাকায় এরা ইলেকট্রন আদান প্রদান বা শেয়ারের মাধ্যমে সাধারণত যৌগ গঠন করে না।
পরমাণুর আকার : পরমাণুর আকার একটি পর্যায়বৃত্ত ধর্ম। যে কোনো পর্যায়ে বামদিক থেকে ডানদিকে পরমাণুর আকার হ্রাস পায় এবং একই গ্রুপে উপর থেকে নিচের দিকে পারমাণবিক আকার বৃদ্ধি পায
আয়নিকরণ শক্তি: একই পর্যায়ে বামদিক থেকে ডানদিকে মৌলসমূহের আয়নিকরণ শক্তি হ্রাস পায়।
অপধাতু বা উপধাতু : যে মৌলের ধাতু ও অধাতু উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাকে অপধাতু বা উপধাতু বলা হয়। যেমন : বোরন ( B ), সিলিকন (Si), আর্সেনিক (As), টেলুরিয়াম (Te) ইত্যাদি।
সক্রিয় ধাতু ও অধাতু : পর্যায় সারণির সর্ববামের ধাতুগুলো সক্রিয় ধাতু। যেমন : Na, K ইত্যাদি। অন্যদিকে, পর্যায় সারণির ডানদিক থেকে ২য় গ্রুপে রয়েছে সক্রিয় অধাতু। যেমন, F, CI ইত্যাদি।
*রাসায়নিক ক্রিয়াশীলতা পর্যায় সারণির বামদিকের গ্রুপগুলোর উপর থেকে যত নিচের দিকে নামা যায়, মৌলগুলোর রাসায়নিক সক্রিয়তা তত বাড়তে থাকে। কিন্তু পর্যায় সারণির ডানদিকে অবস্থিত একই গ্রপের মৌলগুলোর ক্ষেত্রে উপর থেকে যত নিচের দিকে নামা যায়, মৌলগুলোর রাসায়নিক সক্রিয়তা তত কমতে থাকে। যেমন, 17 গ্রুপের হ্যালোজেন মৌলগুলোর মধ্যে F-এর সক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি এবং I -এর সক্রিয়তা সবচেয়ে কম।
এই অধ্যায়ের সকল নোট এর পিডিএফ পেতে এখানে ক্লিক করুণ---
Download Now